ধারাবাহিক- অজানা অভিশাপ (পর্ব-৫)

অজানা অভিশাপ (পর্ব-৫)
-সুপর্ণা নাথ

 

 

আমি ব্যাগে হোলি ওয়াটার, ফাদারের দেওয়া ক্রস, মারিয়ানার দেওয়া একটা ছোট পাউচ্ সব গুছিয়ে রেখেছিলাম, জানি না এগুলো কোন কাজে লাগবে, জানি না আমি ঠিক কি করতে যাচ্ছি শুধু এটা জানি যে ওই অভিশপ্ত Casa de Monte র কয়েদ থেকে আমার তিয়াসকে বের করতেই হবে।
ফাদার বলেছিলেন, উপায় দু’টো- এক যদি শয়তানকে ওর বাড়িতে পুনরায় ঢোকানো অথবা ওকে প্রাণে মেরে ফেলা। মানে যে শরীর নিয়ে ও ঘুরছে তার বিনাশ। যদিও সেটা নেক্সট টু ইম্পসিবল । দু’শো বছর আগেও কেউ তা পারেনি।
সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার।

আমরা দু’জন গাড়িতে উঠে বসলাম, গাড়ি স্টার্টের শব্দে বোধয় মারিয়ানা জেগে গেছিলো। গাড়ি মেইন গেট দিয়ে বেরোনোর সময় পেছন থেকে ওর চেঁচানোর শব্দ শুনতে পেলাম, ও আমাকে মানা করছে। কিন্তু আমি মরিয়া। আমি সরাসরি Casa de monte র রাস্তা ধরলাম না, Fontainhas এর রাস্তা নিলাম। শহরের পশ্চিমে Ourem Creek (Creek – নদীর থেকে ছোট কিন্তু নালার থেকে বড় ) আছে তার পাশ ঘুরে একটা রাস্তা আছে যেটা আবার পাহাড়ের উপরের দিকে উঠেছে।
কারো মুখে কোনো কথা নেই। জানিনা ও কিছু আন্দাজ করতে পারছে কিনা। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা আমার নেই। রাস্তার দিকে নজর নিবদ্ধ। হঠাৎ একটা বিশ্রী খিক খিক হাসিতে চমকে ফিরে তাকাই, এ কি দেখছি!
তিয়াসের মুখ বদলে যাচ্ছে এক লোলচর্ম বৃদ্ধার মুখে, চোখ দু’টো হিংস্র হলদেটে, চোখের ছাই রঙা মনি দুটো চোখের সাদা অংশের সাথে এমন ভাবে মিশে গেছে যে তাদের অস্তিত্বই বোঝা যাচ্ছে না আর তার ফলে চোখ দু’টো মারাত্মক ভয়ঙ্কর লাগছে।
সে খসখসে গলায় বলল
– এত ঘুরে casa de monte তে যেতে হয় নাকি? তুমি আমাকে এত বোকা ভাবলে? তুমি আমাকে টোপে ফেলানি আমি ফেলেছি তোমাকে।

আমার চমকের ঘোর না কাটতেই ও ঝাঁপিয়ে পরে আমার উপর। বীভৎস কর্কশ একজোড়া হাত আমার গলা চেপে ধরেছে, তীক্ষ্ণ নখ গুলো বসে যাচ্ছে আমার গলায়, রক্ত চুঁইয়ে নামছে বুকের উপর দিয়ে বুঝতে পারছি, আমি ড্রাইভ করা থামাই নি, যে করেই হোক আমি ওকে ওর অভিশপ্ত আস্তানাতে নিয়ে যাবোই।
ওর চোখ দু’টো নিস্পলক ভাবে আমার চোখের দিকে চেয়ে আছে। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। ফাদারের কথা মনে পড়ে গেলো, ও তার শিকারকে হিপনোটাইজ করে। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে যা হোক করে ড্রাইভ করছি অন্য হাতে আন্দাজে ব্যাগ হাতড়ে পেয়ে গেলাম হোলি ওয়াটারের পট, মুহূর্তে ছিটিয়ে দিলাম ওর উপর, ও ছিটকে সরে গেলো আমার উপর থেকে। গাড়ির দরজা খুলে পালানোর উপক্রম করতেই আমি প্রতিটা ডোর আর সামনের কাঁচের উপর ছিটিয়ে দিলাম হোলি ওয়াটার, আর ক্রসটা মুঠিতে চেপে ধরলাম।
ও বন্দি কোনো দরজাই ছুঁতে পারছে না। মারিয়ানার দেয়া মালাটা ছিঁড়ে গেছে। ও রাগে ফুঁসছে আমার উপর ঝাঁপাতে গিয়েও পারছে না। এটাই আমার শেষ সুযোগ। আমি নিজে শেষ হয়েও তিয়াসকে বাঁচাবো। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে অরিকে টেক্সট করে সবটা জানিয়ে দিয়েছি। আমি তিয়াসের কাছে পৌঁছতে না পারলেও অরি যাতে অন্তত ওকে খুঁজে পায়।

গাড়িটা রাস্তার ধারে পার্ক করে, গাড়ির ব্যাক সিটের পায়ের কাছে রাখা পেট্রোলের জারটা নিয়ে ছিটিয়ে দিলাম সারা গাড়ির ভেতর, সামনের মূর্তিটা তখন ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতম রূপ নিয়েছে। বীভৎস সে মুখের আকৃতি। গলিত শবের মতো গন্ধ বেরোচ্ছে। সে তার শেষ চেষ্টা করলো তীব্র আক্রোশে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, আমি হাত দিয়ে আড়াল করতে একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করলাম, দেখলাম আমার ডান হাতের কনুইয়ের নিচের থেকে এক খাবলা মাংস ছিঁড়ে নিয়েছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, হাতটা অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু না, এখন নিজের কষ্ট ভেবে লাভ নেই, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তো পুড়ে ছাই হয়ে যাবো, আর ছাই হবে ওই পিশাচ। তাতে দুঃখ নেই। শেষবারের মতো চোখ বুজে তিয়াস আর অরির মুখটা মনে করলাম। বাম হাতে লাইটারটা ছিল, সেটা জেলেই ছুঁড়ে দিলাম পিশাচের উপর, মুহূর্তে দপ করে আগুন লেগে গেলো। আমি দরজা খুলে বেরোতে গেলেই পিশাচ পালানোর পথ পেয়ে যাবে তাই আমাকেও …. তিয়াস বাঁচুক, আর কিছু চাই না। অসহ্য আগুনের তাপ আমি আর সইতে পারছি না‌। আমার চেতনা অবশ হয়ে আসছে, সেই অর্ধ চেতনে দেখলাম সামনে এক জ্বলন্ত মূর্তি বীভৎস শব্দে চিৎকার করছে। আমার আর কিছু মনে নেই আমি চোখ বুঝলাম।

খুব ঠান্ডা একটা ঘরে চোখ খুললাম, মাথার উপর সাদা আলো, এটা কি স্বর্গ! হঠাৎ এক অচেনা মানুষের মুখ দেখতে পেলাম সে ঝুঁকে পড়ে আমাকে দেখছে আর তারপর কাকে যেন ডাকলো, আর তারপরেই এক অতিপরিচিত ব্যাকুলতা মাখা আনন্দিত স্বর শুনলাম …. অরি!

ও আমার মাথায় আলতো করে হাত রাখল, আমার প্রথম প্রশ্ন
– তিয়াস?
– তুমি চিন্তা করোনা তনু, তিয়াস ভালো আছে।
– ম্যাডাম, তুমি তো অসাধ্য সাধন করেছ! (হাসি মুখে মারিয়ানা বললো।
– তুমি ঠিক আছো তো?
– সবাই ভালো আছে, তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি চল। তুমি না থাকলে বাড়ি ফাঁকা লাগে যে।

আমার বাম হাতের আর পিঠের পাশটা বেশ একটু পুড়েছিলো। প্রায় দুই সপ্তাহ পর হসপিটাল থেকে ফিরলাম। আমি তিয়াসকে দেখার জন্য উদগ্রীব। ও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, মা ও মেয়ে বেশ কিছুটা কান্নাকাটি করলাম। ও আমার কোলে মাথা রাখতেই আমি আগে ঘাড়ের পেছনের চুলটা সরিয়ে দেখলাম এবং আশ্বস্ত হলাম, আমার তিয়াস …. সত্যি আমার তিয়াস।

মারিয়ানা আর অরির দিকে তাকিয়ে বললাম,
– এবার সবটা গুছিয়ে বলো তো তোমরা।
আগে বলো আমি আগুন থেকে বেরোলাম কি করে?
মারিয়ানা বলতে যাওয়ার আগেই স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে হৈ চৈ করে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে অদ্রিয়ানো বললো,
– ম্যাডাম, আমি বলবো, নাহলে ওই স্টুপিড মেয়েটা সব ক্রেডিট একা নিয়ে নেবে। বলেই চোখ টিপে হাসলো।
মারিয়ানা মুখ বেঁকিয়ে অন্য দিকে তাকালো,
– আচ্ছা যে খুশি বলো, বাট প্লিজ বলো।
মারিয়ানাই শুরু করলো,
-সেদিন ফাদারের ওখান থেকে ফিরে আমরা যখন ভাবছি কি করবো তখনই আমি অদ্রিয়ানোকে টেক্সট করে দিয়েছিলাম, যে ও যেন একটা গাড়ি নিয়ে বাড়ির বাইরে ওয়েট করে কেন না, বাড়ির ভেতরে কোনো প্রবলেম হলেই ও যাতে আমাদের জন্য হেল্প আনতে পারে।

আমি বুঝিনি যে আপনি এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন। একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ গাড়ির আওয়াজে ঘুম ভাঙে, আমি আপনাকে ডাকি, বারণ করি কিন্তু ততক্ষণে আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন, সাথে সাথে আমি আমার দিদুর দেয়া জিনিসগুলো নিয়ে অদ্রিয়ানোর গাড়িতে গিয়ে উঠি,
– ওহ্ ফাদারের বাড়িতে যে ব্যাগটা তোমার হাতে ছিল?
– হ্যাঁ, ফাদারই আমাকে বলেছিলেন যে দিদুর কাছ থেকে কিছু স্পেলড আইটেম, মানে মন্ত্রপুত জিনিস পত্র আনতে যা কিনা পিশাচকে শায়েস্তা করতে কাজে লাগতে পারে।
-তারপর?
– আমাদের গাড়ি তোমাদের পিছু নেয়, তারপর রাস্তার ধারে তোমার গাড়ি দাঁড়ায়। অদ্রিয়ানো তাড়াহুড়ো করছিল। আমি বাঁধা দিই, কেননা পিশাচ যে ঠিক কি করতে পারে তার ধারণা আমাদের নেই। কিন্তু হঠাৎ গাড়ির ভেতরে আগুন জ্বলে ওঠে।
এবার অদ্রিয়ানো বলে,
– আমরা দৌড়ে যাই দরজা খোলা যাচ্ছিল না, আগুনে তেতে উঠেছিল। তখন রাস্তার একটা পাথর দিয়ে কাঁচটা ভেঙে ফেলি। একটা আগুনের হলকা বেরিয়ে আসে। যা হোক করে জ্যাকেট দিয়ে হাতটা মুড়ে হাত ঢুকিয়ে লক খুলি। ম্যাডাম দরজা খোলা মাত্রই আপনি লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়, কপাল ক্রমে আমার গাড়িতে দু’টো দশ লিটারের জলের পট ছিল। বিকেলেই কিনেছিলাম। কাল অফিসে সাপ্লাই দেবার ছিল। মারিয়ানা সেই জল আপনার গায়ে ঢেলে দেয়। আগুনটা নেভে আর হঠাৎই সেই দরজা দিয়ে আগুনের একটা মূর্তি বেরোনোর চেষ্টা করে …
মারিয়ানা ওকে থামিয়ে আবার বলা শুরু করে,
– পিশাচ আগুনে জব্দ, তবু সে শেষ চেষ্টা করে পালানোর। সাথে সাথে আমি দিদুর দেয়া আয়রন নেটটা ওর উপর ছুঁড়ে দিই, এটা একটা পাতলা লোহার তারে বানানো জাল যার সাথে মন্ত্রপুত কড়ি আর বিডস বোনা থাকে। যে কোনো অশুভ আত্মাকে বন্দি করতে পারে এটা। ব্যাস পিশাচও বেরোতে পারে না। সাথে তার উপর ওই নুন আরো ছিটিয়ে দিই। আমাদের চোখের সামনে শতাব্দী প্রাচীন বিভীষিকা জ্বলে শেষ হয়ে যায়। এক ছিটে ফোঁটা ছাইও অবশিষ্ট থাকে না। তার পর অদ্রিয়ানো আপনাকে নিয়ে হসপিটালের দিকে যায়।

এবার অরি বলা শুরু করে ,
-অফিসে কাজের ফাঁকে তোমার sms পেয়ে আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়। বারবার তোমাকে ফোনে ট্রাই করে না পেয়ে আমি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি। বাড়িতে এসে দারোয়ানের কাছে শুনি কেউ নেই বাড়িতে, তখন মারিয়ানাকে কল করি, যে সে কিছু জানে কিনা। ও ওদের লোকেশন জানায় আমি পৌঁছে যাই, ততক্ষণে তোমাকে হসপিটালে নিয়ে গেছে অদ্রিয়ানো। মারিয়ানাকে তোমার টেক্সট এর কথা বলতেই ও বললো, এখুনি আমাদের Casa de monte তে যেতে হবে।

রাতের আঁধারে অচেনা মৃত্যু পুরীতে গিয়ে পৌঁছাই। মারিয়ানা আমাকে নিয়ে সোজা দোতলায় যায়। সেখানে গিয়ে দেখি তিয়াস অচৈতন্য হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ওর চেহারা দেখে চমকে যাই। গাল বসে গেছে, চোখ কোটরাগত, সারা গায়ে কেমন একটা দাগ, চোখে মুখে কি এক কষ্টের ছাপ স্পষ্ট।
মারিয়ানা বলতে লাগল,
– আমি দিদির গায়ে, মাথায় হোলি ওয়াটার ছিটিয়ে দিই, গলায় রোসারি মালা পরিয়ে দিই। ওর স্পিরিচুয়াল ক্লেনসিং করে ওকে ওই বাড়ি থেকে বের করে সোজা হসপিটালে যাই।

আমি তিয়াসকে বললাম,
– আমি এটাই বুঝতে পারছি না তুই ওই বাড়িতে কবে আর কখন গেলি? আর কেনই বা গেলি। আর তোর যাওয়ার সাথে সাথেই ওই পিশাচ এই বাড়িতে কেন এলো?
-পিশাচ না ডাইনি নাকি অন্য কিছু তা তো জানি না মা, আর সে এ বাড়িতে কেন এলো তাও জানি না। তবে এ বাড়িতে আসার পর ওই বাড়িটা আমার নজরে আসে। শুনে অবাক হই যে তোমাদের চোখেই পড়েনি বাড়িটা এতদিনে! জঙ্গলের মধ্যে পোড়ো বাড়ি; বিষয়টা দারুণ থ্রিলিং লাগে আমার, তবে বাড়িটার দিকে প্রথম প্রথম নিজের ইচ্ছাতে তাকালেও পরের দিকে মনে হতো কি এক অমোঘ আকর্ষণ আছে ওই বাড়িটার, না চাইলেও যেন সারাটা দিন ওর দিকেই চেয়ে থাকতে মন চায়!

বাইনোকুলারটা আনার পর সেদিন রাতে দেখলাম ভাঙা বাড়িতে আলো জ্বলছে। খুব মৃদু আলো আর নোংরা অর্ধস্বচ্ছ কাঁচের ভেতরে একটা অবয়ব। একটা মানুষ আর তাকে দেখতে আমার মতো! অবিকল আমার মতো! তোমাদের বললেও তোমরা অতটা কেয়ার করতে না। ইনফ্যাক্ট তোমরা দেখতেও পেতে না কিছু। তাই বলিনি, ভেবেছিলাম বলা তো যায় না কাউকে আটক রেখেছে হয়তো ওখানে, তাই যেদিন তোমরা বাবার অফিসের বন্ধুর ইনভিটেশন অ্যাটেন্ড করতে গেলে আমিও চুপিসারে বেরিয়ে পড়লাম।

বন জঙ্গলে ভরা বাড়ির সামনেটা, বাড়ির সিঁড়িতে পা দিতেই মচমচ করে উঠলো যেন জানান দিলো কত দিন পর কোনো মানুষের পা পড়েছে ওখানে। আমি খোলা দরজা দিয়ে উপরে উঠে যাই, হঠাৎ সামনে দেখি একটি মেয়ে একদম আমার মতো দেখতে, সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে, আমার মাথাটা ঘুরে গেলো মুহূর্তে চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল। যখন চোখ খুললো দেখলাম আমি বন্দি একটা অন্ধকার বাড়িতে। চিৎকার করলাম জানালাতে আঘাত করলাম কেউ শুনলো না। তোমাদের কথা খুব মনে পড়ছিল। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন সারাক্ষণ বেরোনোর পথ খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেও পেলাম না। খিদে তৃষ্ণাতে আর পারছিলাম না, হঠাৎ জ্যাকেটের পকেটে রাখা দু’টো চকলেটের কথা মনে পরে, ভুলেই গিয়েছিলাম, খুব অল্প পরিমাণে সেটা খাই, এটুকুই সম্বল। তবে সেটা আর কদিন? পরের দিন তাও শেষ। শরীরে কোন বল পাচ্ছিনা, মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। অনেক রাতে মুখে জলের ছিটে লাগায় চোখ খুলে দেখি বাইরে ভীষণ জল ঝড় আর ছাদের ফাটল দিয়ে অঝোর ধারায় জল পড়ছে, আমি প্রাণ ভরে সেই নোংরা জলই খেলাম, তারপর সমস্ত শক্তি জোগার করে উঠে চার দিকে খুঁজতে থাকি কোনো পাত্র পাওয়া যায় কিনা, অবশেষে একটা ভাঙা টিনের বালতির মতো কিছু একটা পাই সেটা পেতে দিই ওই ফাটলের নীচে, সারা রাতের অঝোর বৃষ্টিতে জলে ভরে যায় ওটা। বাকি দিনগুলো ওটাই ছিল আমার লাইফ লাইন। শেষের দিকের দিনগুলো একটা আছন্ন ভাব লাগতো যখন জ্ঞান আসতো জানলাতে নক করতাম। তার পর হঠাৎ এক দিন কয়েকটা চেনা গলার স্বর …বাবা …মারিয়ানা। ওদের দেখার পর আমি জ্ঞান হারাই। তার পর চোখ খুলি হসপিটালে।
– চুপ কর বাবু, কত কষ্ট পেয়েছিস তুই আমি আর শুনতে পারছি না।
– মা, আমি তো তোমার কাছে এখন, কোনো ভয় নেই।

অরি আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি এত কিছু করলে কি করে, আমিতো কিছুই জানতে পারিনি …. তুমি বলোনি কেন তনু?
– তোমাকে বলিনি না, বলার চেষ্টা করেও পারিনি, এক তুমি এসব মানো না, পুরোটা বুঝতে পারতে না, আমি নিজেও বুঝেছি অনেক পরে। ঠিক বুঝিনি একটা সন্দেহ করেছিলাম মাত্র।
আর কি করে পারলাম? এই যে আমার এই দু’টো ছেলে আর মেয়ে অদ্রিয়ানো আর মারিয়ানা এদের সাহায্যেই সবটা সম্ভব হয়েছে।
– কিন্তু তনু সন্দেহ কি করে হলো?
– তিয়াসের অদ্ভুত ব্যবহার, সারাদিন অন্ধকার ঘরে বসে আছে। খেত না।
– আর ..
অদ্রিয়ানো মাঝখানে বলে ওঠে,
– খাবে কি করে ম্যাডাম, সারা রাত তো খেয়ে বেড়াতো শিকার করে আর সারাদিন অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতো।
– তনু তোমার সন্দেহর কথাটা বললে না?
– সেদিন ওই বহুরূপীটা আমার কাছে বসেছিল। বলেছিল চুলে তেল দিয়ে দিতে। আমি চুল সরিয়ে ওর ঘাড়ের কাছটা দেখি সেখানে ওর ত্রিশূল এর ট্যাটুটা দেখতে পেলাম না। তখনই মনে হলো এ আমার তিয়াস না। কখনো না।
মারিয়ানা বললো,
– পিশাচ, ঈশ্বর সংক্রান্ত কোনো চিহ্ন কি বহন করতে পারে ম্যাডাম; তাই সব নকল করলেও ওটা পারেনি।
– কিন্তু মারিয়ানা, তোমাদের এই পিশাচ আমাকেই কেন টার্গেট করলো?
– আসলে আমরা যারা এখানের বাসিন্দা সবাই কম বেশি জানি ওই বাড়ির সম্পর্কে, সবাই এড়িয়ে চলি। আর পাহাড়ের এত উপরে বাইরের লোক তত আসে না, আসলেও তারা রাস্তা ধরে যাতায়াত করে এই উল্টো পথে জঙ্গলে কেউ এসে না। আর এ বাড়িতে ওই ডাইনির এমন জাদু ছিল যে তুমি সম্মোহিতের মতো টান অনুভব করেছিলে। আর দিদি হতে পারে এটাই গডের প্ল্যান ছিল যে তুমিই হবে ওর শেষের কারণ।
ম্যাডামের হাতেই ওর শেষ লেখা ছিল।

– আচ্ছা তনু, কি এই শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস?
– আমি ফাদারের কাছে শুনেছি বটে তবে মারিয়ানা ব্যাপারটা বেশি ভালো গুছিয়ে বলতে পারবে।
– বেশ তুমিই বলো। তবে তার আগে এক রাউন্ড কফি হলে ভালো হতো, তাই না।
অদ্রিয়ানো বললো,
– স্যার একদম আমার মনের কথা বললেন।
কফির কাপ নিয়ে আবার সবাই গুছিয়ে বসলাম জমিয়ে কিংবদন্তির গল্প শুনতে। মারিয়ানা শুরু করলো,
– এটা পর্তুগিজ অধ্যুষিত এলাকা ছিল, ইংরেজরা সারা ভারতে প্রতিপত্তি বিস্তার করলেও এখানে তখনও জমিয়ে বসতে পারেনি। কয়েকজন ক্যাথলিক এখানে বসতি স্থাপন করেন তবে তারা আমাদের পূর্ব পুরুষদের সাথে মিলে মিশে থাকতো। তেমনই একজন ছিলেন Jacob Adley, ব্যবসা করে প্রচুর টাকা উপার্জন করে পাহাড়ের একদম উপরে নিও গথিক আর্কিটেকচার এ দারুণ এক বাড়ি বানান। এখানে সব বাড়ির থেকে আলাদা। নাম দেন Casa de Monte, হিল ম্যানশন।

বছর ঘুরতে তিনি আবার বাণিজ্যে যান চাকরবাকরদের উপর বাড়ির ভার দিয়ে। ফেরেন সাথে বিয়ে করা বউ নিয়ে, সে নাকি ছিল অপ্সরাদের মতো সুন্দরী। নাম ম্যাডেলাইন। আর তেমন মিষ্টি ব্যবহার, তবে ঈশ্বর তাদের সব দিলেও সন্তান সুখ দেন নি। বেশ কয়েকবার সন্তানসম্ভবা হয়েও, জন্মের আগেই সন্তানদের হারায়।

তার পর থেকেই তার ব্যবহার বদলে যেতে থাকে, এমনিতেও পাহাড়ের উপরে ততো বসতি ছিল না। তবে কথা হওয়ায় ভাসে। লোক মুখে প্রচার হয় ওই বাড়ির সব চাকর বাকররা এক এক করে উধাও হয়ে যাচ্ছে। জ্যাকব ব্যবসার কাজে অনেক মাস বাড়ির বাইরে থাকতো। সে কিছু জানতে পারে না।

তার পর হঠাৎ নিচের জন বসতিতে পোষা প্রাণী, রাস্তার কুকুর এমনকি মানুষের উপর আক্রমণ শুরু হয়। রোজ রাতে শিকার করতো কেউ, ছিঁড়ে খেত তার শিকারকে। মানুষ জন ক্ষেপে ওঠে। রাত পাহারা, চার্চে প্রার্থনা সব শুরু হয়। হঠাৎই একজন কোনো কারণে জঙ্গলে গেছিলো, সে দেখে ম্যাডেলাইন একজন মানুষকে কামড়ে খাচ্ছে, তারপর আধ খাওয়া মড়াটা ফেলে সে বাড়িতে ঢুকে যায়।
তার কাছে সব শুনে গ্রামের মানুষরা প্রিস্টকে সাথে নিয়ে হিল ম্যানশনে হামলা করে, ম্যাডেলাইন কিছু না জানার ভান করে। মানতে চায় না কিন্তু প্রিস্টরা অনেক রকম রিচুয়াল ইত্যাদি করে তাকে জব্দ করে ফেলে। তখন সে বলে, সে সন্তানের কামনায় শয়তানের কাছে, নিজের আত্মা উৎসর্গ করেছে। নরমাংস খাওয়া তার শয়তানি রিচুয়ালেরই অংশ। এতে তার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। সে এটাও স্বীকার করে জ্যাকব আর তার সব চাকরদের সেই মেরেছে। প্রিস্টরা সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করেও তাকে প্রাণে মারতে পারেনি আর ম্যাডেলাইনকে বন্দি করার আগেই সে তার বাড়িতে ঢুকে যায়। বাড়িটা তার জাদু, ডাইনি বিদ্যা দিয়ে এমন ভাবে ঘেরা ছিল যে তার ভেতর ঢোকা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি।
তখন তাকে বাড়ির ভেতরেই বন্দি করে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে মন্ত্র বলে বাড়িটা বেঁধে দেয়া হয়। যাতে ম্যাডেলাইন আর কোনোদিনও তার অভিশপ্ত বাড়ি থেকে বেরোতে না পারে। কাল ক্রমে না খেতে পেয়ে বন্দি হয়ে তার মৃত্যু হয় আর তার শয়তানি আত্মা মারাত্মক পিশাচে পরিণত হয় আর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে। আর বাকিটা তো …

অরিন্দম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– কি বিচিত্র! এ ও কি সম্ভব?
অদ্রিয়ানো বললো,
– স্যার, কত কিছুই তো চোখে দেখা যায় না, তাই বলে কি তা নেই? এই যেমন ধরুন এই স্টুপিড মেয়েটার ঘটে এত বুদ্ধি আর সাহস ছিল কে জানতো?
মারিয়ানা রাগে কট মট করে ওর দিকে তাকালো,
আমরা সবাই হা.হা.হা করে হেসে উঠলাম।
তিয়াসের মুখটা সকালের ঝলমলে রোদ্দুরে আরো মিষ্টি লাগছে।
ঈশ্বর তুমি সবাইকে ভালো রেখো ।

=সমাপ্ত=

Loading

Leave A Comment